মরু-মৃগয়া ~ চিত্তরঞ্জন মাইতি
লেখক পরিচিতি:-
চিত্তরঞ্জন মাইতি আধুনিক কালের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক, গল্পকার ও উপন্যাসিক। শিশু
সাহিত্যিক হিসেবেও তার পরিচিতি আছে। তার সাহিত্যচর্চা শুরু হয় স্কুল জীবন থেকেই।
স্কুল জীবনের লেখা প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় “শিশু সাথী” পত্রিকায়।
কবি হিসেবে ও তিনি সুপরিচিত। তার অন্যতম উপন্যাস গুলির মধ্যে একটি হলো “পাতার ভেলা ভাসাই”,
এটি আত্মজীবনীমূলক। এছাড়া “আঁধার পেরিয়ে”, “অগ্নিকন্যা”, “অনন্যা”, “অনুরাগিনী”, “আপন ঘর” ইত্যাদি তার জনপ্রিয় সৃষ্টি।
প্রধান চরিত্র
সমূহ:- উপন্যাসে বর্ণিত অনেক চরিত্রই আমাদের পরিচিত
এবং বিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। তবু যে সমস্ত চরিত্রের
কথা না বললে উপন্যাসটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তাদের কথাই তুলে ধরা হলো।
১) কুমারায়ণ:- উপন্যাসের প্রথম পর্বের প্রধান চরিত্র। কুমারায়ণ এক যুবা, আবেগপ্রবণ, তরুণ পুরুষ। দেশ দর্শন তার পেশা। পন্ডিত বংশের সন্তান সে, ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী, পালি ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত বৌদ্ধ শাস্ত্র রপ্ত করেছে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অসাধারণ বংশীবাদক, সুর-ঞ্জান, কর্তব্য পরায়নতা তার অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
২) জীবা:- জীবা ছিলেন কুচি নগরের বাসিন্দা এবং গল্পের প্রধান নারী চরিত্র। রহস্যময়িতা, বাকপটুতা, সৎ-নির্লোভী মনোভাব হল ‘পরমা সুন্দরী' জিবার অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তার আরেকটি গুণ হলো-
“শক্তিমান সম্রাটের থেকে গুণবান বিদ্বানেরই সে পূজারী।“
‘নৃত্য' ও ‘গীতি’ পটিয়সী জীবার প্রকৃত পরিচয় জানা যাবে উপন্যাসের প্রথম পর্বের শেষ দিকে।
৩) রাজকন্যা বেতসা:- বেতসা ছিলেন অর্জুনায়নের রাজকুমারী। বুদ্ধিতে দীপ্তি, স্বভাবে মিষ্টতা, কর্তব্যে নিষ্ঠা বেতসার সহজাত গুণ। শোভন-সুন্দর-মার্জিত ব্যবহার ও মনমুগ্ধকর চাতুর্য বেতসাকে আরো অদ্বিতীয়া করে তুলেছে।
৪)গব্বারাম:- গল্পের সব থেকে রসিক চরিত্র। গ্রাম-গেয়ো গীত গাইতেন খুব সুন্দর। প্রায়শই বলতেন- “রাজার বাড়ির ঘোড়া সামনে হাঁটে, পেছনে হটে” ।
অর্থাৎ, রাজা যখন যুদ্ধে জেতে ঘোড়া সামনে ছোটে, আর যখন যুদ্ধে হারে তখন ঘোড়া পেছনে ছোটে ।
৫)গুরু ভবদেব :- তিনি ছিলেন তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধনুর্বিদ্যার
শিক্ষক এবং এক রাজ্যত্যাগী রাজপুত্র। স্বেচ্ছায় তিনি রাজ্য ত্যাগ করে সন্ন্যাস
জীবন গ্রহণ করেন।
৬)কামকান্তি :- উপন্যাসের প্রধান খলনায়ক এবং নামের মতনই এক
বিষধর চরিত্র।
৭)কুমারজীব:- গল্পের দ্বিতীয় পর্বের প্রধান পুরুষ চরিত্র এবং একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুক। কুমারজীব নামটার উৎপত্তিও উপন্যাসে খুব সুন্দর ভাবে বর্ণিত আছে।
কুমারজীব নামের
রহস্য এবং পরিচয় পাঠকের জন্যই উহ্য থাকল।
৮)রাজা মেঘবাহন:- রাজা মেঘবাহন ছিলেন তৎকালীন কাশ্মীরের রাজা।
অত্যন্ত হৃদয়বান, প্রজাহিতৈষী, সুদক্ষ, শান্তিপ্রিয় শাসক। বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তার অনুরাগ ও
ন্যায়পরায়ণতা বিশেষভাবে উল্লেখ্য।
৯) চম্পা:- রাজা মেঘবাহনের অত্যন্ত আদুরে কন্যা ছিলেন
চম্পা। বাক-চঞ্চল, গম্ভীর স্বভাব কিন্তু আচার-আচরণ সামান্যতম ঔদ্ধত্য প্রকাশ পেতনা। প্রকাশ পেত তৃপ্তি দায়ক মাধুর্য।
১০)বিক্রমকেশরী:- রাজা অমিতবীর্যের পুত্র। চারিত্রিক নমনীয়তা থাকলেও রাজবংশীয় অহংকার ও দূর্দমনীয় মনোভাব প্রকাশ পেত আচার-আচরণে।
১১)বাক :- গুরু মাধব স্বামীর আশ্রম কন্যা ছিলেন বাক। সমাজের নিষ্ঠুরতার স্বীকার এক ভাগ্যবর্জিতা কন্যা। তার অনেক গুণের মধ্যে অন্যতম একটি গুণ হল অসাধারণ চিত্রাঙ্কন প্রতিভা । তার তুলির টানে জীবন্ত হয়ে উঠতো অঙ্কিত চিত্রের প্রতিটি চরিত্র।
কাহিনী
প্রেক্ষাপট:- এক বণিক দলের
সাথে দেশ ভ্রমণের নেশা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে এক তরুণ ভারতীয় যুবক কুমারায়ণ। তক্ষশীলা
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শাস্ত্র ও
অস্ত্রশিক্ষা তার এক অপরাজেয় শক্তি ও ভরসা। দলটি চলেছে তিয়েনশান পর্বতমালা বেয়ে কুচি নগরের পথে। দিনের শেষে ভুরুক অঞ্চলে তারা পটাবাস স্থাপন করে
বিশ্রাম নেবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু রাতের অন্ধকারে অনতি দূরে তারা হঠাৎই দেখেন
কিছু রহস্যময় আলোর ছটা আকাশে। বণিক দলের অন্যান্য সদস্যরা নিছক বুদ্ধ-পূর্ণিমা উৎসব উদযাপনের আলোর ছটা বলে অবহেলা
করলেও তারুণ্যের উৎসাহে কুমার এগিয়ে যায় সেই আলোর উৎসের সন্ধানে। সেখানে এগিয়ে
যেতেই দেখে কিছু ছিন্নভিন্ন দেহ ছড়িয়ে পড়ে আছে, আর জীবিত সদস্য বলতে একমাত্র এক
অপূর্ব সুন্দরী নারী 'জীবা'। দুর্ধর্ষ হুণ জাতির
আক্রমণের মুখে পড়েছিল সম্পূর্ণ দলটি। জীবা তার পরিচয় দেয় কুচি
নগরের রাজকুমারীর একান্ত সহচরী হিসাবে। শুরু হয় দুজনের একসাথে পথ
চলা। এদিকে হুনদের আক্রমণের কথা শুনে, বণিক দল সিদ্ধান্ত নেয় পথ বদলাবার। এমনকি
জীবার দায়িত্ব নিতেও তারা প্রস্তুত নয়। কিন্তু কুমার একাকী
নারীকে ফেলে যাবার পক্ষপাতিত্ব নয়, সে বণিক দলের সঙ্গ ত্যাগ করে জীবাকে নিয়ে
গোদানের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। অসম্ভব সম্ভ্রম ও পরস্পরের প্রতি
দায়িত্ববোধের মাধ্যমে তারা ক্রমশ একান্বিত হতে থাকে। কুমারের ব্যক্তিগত জীবন,
যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চনা, তার শিক্ষা, মার্জিত বোধ,
সম্ভ্রান্ত আচরণ সমস্ত কিছুর জন্যই সে ছিল জীবার কাছে অনন্য। কুমারের সাথে রাজা সমুদ্রগুপ্তের অরণ্যে পরিচয়,
সমুদ্রগুপ্তের প্রতি কুমারের আনুগত্যতা এবং সমুদ্রগুপ্তের প্রধান উপস্থাপিকা
রাজকুমারী বেতসা-র কুমারের প্রতি গুণগ্রাহীতার
কাহিনী জীবাকে আরো বেশি করে কুমারের কাছে আনে।
কুমারায়ন ছিল
এক ভাগ্য বর্জিত রাজকুমার। ভাগ্যের কঠোর পরিহাসে যাযাবর জীবনকেই সে নিজের পাথেয় করে নিয়েছিল। কিন্তু জীবাকে নিয়ে গোদানে পৌঁছাবার পর সেখানকার ধর্মমতি কুমারায়নকে
গৃহী-র জীবনযাপনের উপদেশ দেন এবং জানান এতেই তার
মঙ্গল হবে।
কিন্তু কুমার
তখনো অপ্রস্তুত –
তবে ?
- · কুমার কি পারবে গৃহী-র জীবনে পদার্পণ করতে ?
- · জীবা কে? তার আসল পরিচয় কি? সে কি সত্যিই কুচির রাজকুমারীর একান্ত সহচরী?
- · কুমারায়ন এবং কুমারজীবের মধ্যে সম্পর্ক কি? কেন-ই বা কুমারজীব নামকরণ হল ?
এগুলির উত্তর
জানতে হলে অবশ্যই চোখ রাখতে হবে উপন্যাসের পাতায়।
পাঠ
প্রতিক্রিয়া :- মরু-মৃগয়া
বৌদ্ধ ভিক্ষু কুমারজীব-এর জীবন কাহিনী। এখানে গুপ্ত-যুগ তথা গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের সমসাময়িক কাহিনী ও ঘটনাবলীর
বর্ণনা পাওয়া যায়। বৌদ্ধ ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের আদর্শের প্রচার এবং ভারতের বাইরে
তা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টিও খুব সুনিপুণভাবে গল্পকাহিনীর সাথে রচিত হয়েছে। বৌদ্ধ ও হিন্দু শাস্ত্রের আদর্শগত মিল সম্পর্কেও আভাস পাওয়া যায়। এছাড়াও তিয়েনশান ও কিউনলুন পর্বতমালার নৈসর্গিক দৃশ্যের বর্ণনাও আছে। ত্যাগ, বিশ্ব মানবতার প্রচার, অনির্বাণ বা মোক্ষ
লাভের পথ, সংঘের আদর্শ ইত্যাদি ও লক্ষ্যণীয়। সবকিছু
মিলিয়ে একটি সুন্দর টানটান উত্তেজনায় পরিপূর্ণ উপন্যাস।
প্রিয় উদ্ধৃতি:-
১) “শক্তিমান সম্রাট-এর থেকে গুণবান বিদ্বানেরই সে পূজারী।“
২) “আমাদের সোনার পিঞ্জরে একটি সুখ পাখি বাঁধা ছিল।.... আমি একদিন তাকে উড়িয়ে দিলাম। সে সবুজ বনের
দিকে উড়ে যাবার জন্য পাখা ঝাপটাল, কিন্তু পারল না, পড়লো গিয়ে প্রান্তরে। আমি
বাতায়ন থেকে দেখলাম, একটা হিংস্র মার্জার ছুটে এসে তাকে মুখে তুলে নিয়ে গেল।“
৩) “বেতসা তখনো বাঁচবার প্রবল ইচ্ছায় স্রোতের তৃণটিকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করতে লাগলো।“
৪) “রাজার বাড়ির ঘোড়া সামনে হাঁটে, পেছনে হটে।“
৫) “মরুভূমি দেখেছো কুমার? বড় তৃষ্ণা, বড় তৃষ্ণা তার। বুক ফাটিয়ে সে চেয়ে থাকে আগুন ঢালা আকাশের
দিকে। একখন্ড মেঘ, শুধু একবিন্দু জলের প্রত্যাশা।“
৬) “ তোমার ওই দুটি নীল চোখের তারায় আকাশ দেখেছি আমি।
তারপর সোনালী সূর্যের অনেক লেখা দেখেছি সে আকাশে।।“
৭) “ প্রভুর প্রতি বিশ্বাস রাখা ভালো কিন্তু
নিষ্ক্রিয় থাকা নির্বোধের কাজ।“
৮) “দেখো কি আশ্চর্য, সিদ্ধার্থ গোপাকে ত্যাগ করে
পথে নেমে এলেন আর আমি জীবাকে গ্রহণ করে সংসারে প্রবেশ করলাম।“
৯) “অতিরিক্ত বায়ুর তাড়নায় অগ্নি যে কেবল
প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে তা নয়, নির্বাপিত হবার সম্ভাবনাও থাকে।“
১০) “একটি শিশুকে একদিন পক্ষছায়ায় আবৃত করে
নিয়ে এসেছিলেন। আজ সে নিজেই আলোর জগতে দুটি পাখা মেলে দিয়েছে।“
Khub valo laglo....!!
ReplyDelete